• Phone: +8801785-408231
  • Email: softtopit@gmail.com
  • Address: Dhaka, Bangladesh
    • Follow us on:

    Blogs > Blog Details

    News and Insights

    image

    ছয়বার ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস সম্পর্কে আপনি কতটা জানেন

    ছোটবেলায় আমি ছিলাম খুব মুডি, ধীর, স্থির ও জেদি। আমি ও মা দেশের বাড়িতে থাকি। বাড়িতে যে কাজের ছেলেটি থাকে, সে প্রতিদিনই কাজের ফাঁকে ছিপ ফেলত পুকুরঘাটে। একদিন ও খেতে গেলে আমিই চুপি চুপি ছিপ ফেললাম। কিছু সময় কাটল। হঠাৎ ছিপ হাত ছেড়ে চলে যেতে চায়, আমিও নাছোড়। কিন্তু বড় বেশি টান, জলে পড়লাম, তখনো হাতে ছিপ। ছাড়ব কেন? হয়তো চিৎকার করেছিলাম, মা ছুটে এসে আমার থেকেও বেশি হইচই বাঁধিয়ে জল থেকে আমাকে তুলে আনলেন। ছিপ তখনো আমার হাতে এবং ছিপের সুতার মাথায় গাঁথা ইয়া বড় এক শোল মাছ। জলে বিপদ সেই প্রথম টের পেলাম। বিপদের মোকাবিলায় সেই সাঁতার শুরু। বয়স তখন চার।

    সাঁতার শেখার আধুনিক টেকনিক প্রথম শেখালেন প্রফুল্ল ঘোষ ও শ্যামাপদ গোস্বামী। তাঁরাই আমার শিক্ষাগুরু। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে যত সাঁতার প্রতিযোগিতা হয়, সব কটিতেই আমি প্রথম হই। এর মধ্যে ১৯৫৫ সালে এক মজার ঘটনা ঘটল। ঢাকায় তখন কোনো সুইমিংপুল ছিল না। চিফ সেক্রেটারি এম এম খান সত্যিকারের ক্রীড়ারসিক ও খেলাপাগল। তিনি একদিন ডেকে বললেন, দেখো, মাস তিনেক বাদে পাকিস্তান অলিম্পিকের আসর জমছে ঢাকায়। পূর্ববঙ্গের ছেলেরা কোন ইভেন্টে সবাইকে টেক্কা দিতে পারবে বলে তোমরা মনে কর? বললাম, সাঁতারে বাংলার ছেলেদের কেউ রুখতে পারবে না। আমাদের কথায় মাত্র আড়াই মাসে একটা আধুনিক সুইমিংপুল গড়ে তুললেন তিনি। সেবার আমি ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটার প্রতিযোগিতায় প্রথম হই।

    ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার পর ব্রজেন দাস
    ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার পর ব্রজেন দাস
    ছবি: সংগৃহীত

    ১৯৫৬ সালে খবরের কাগজে প্রকাশিত এক সাঁতারুর অসাফল্যের সংবাদ আমাকে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমে উদ্বুদ্ধ করে। খবরটা পড়ার পর থেকে ভাবছি, যেভাবে হোক আমাকে ইংলিশ চ্যানেল পার হতেই হবে।

    ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে প্রথম ট্রায়াল। পুলে একনাগাড়ে ১২ ঘণ্টা সাঁতার কাটলাম। নদীতে পরের মাসে। ২৬ মাইল সাঁতার কাটলাম পুলে। ঠিক করলাম অবিরাম ৪৮ ঘণ্টা সাঁতার কাটব। ১৯৫৮ সালের ২৮ মার্চ রাত ২টা ২০। পদ্মার পাড়ে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলাম। সকাল-দুপুর-বিকেল হলো, আমি সাঁতার কেটে চলেছি। হঠাৎ ঝড় উঠল। বছরের প্রথম কালবৈশাখী। সবাই বারবার আমাকে স্টিমারে উঠে আসতে বলছে, ইচ্ছা না থাকলেও শেষ পর্যন্ত উঠে আসতে বাধ্য হলাম। ১৩ ঘণ্টা সেদিন সাঁতার কেটেছিলাম। লক্ষ্য ছিল মাত্র আধমাইল দূরে।

    বহু প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির পর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে লন্ডনে পৌঁছালাম। বিমানবন্দরে পাকিস্তান হাইকমিশনের পক্ষে আমাকে রিসিভ করে। ডোভারে অপেক্ষা করছি। এমন সময় আমন্ত্রণ পেলাম ইতালি-মিসরের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সাঁতার প্রতিযোগিতায়। জল উষ্ণ, দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার। চ্যানেল সাঁতরানোর তখনো এক মাস বাকি। আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। সুন্দর দ্বীপ কাপ্রি থেকে সাঁতার শুরু হবে। নেপলসে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। আমি অ্যামেচার গ্রুপে সাঁতার কাটব। আমি একমাত্র এশিয়াবাসী।

    একটি বোট দেওয়া হলো। ওই বোটেই আমার ম্যানেজার মহসীন ভাই। বোটটি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার ওপরে (পার হয়ে) গেছে, লক্ষ্য (বাকি আর) মাত্র আধমাইল, কিন্তু তখনই স্টিমার থেকে আমাকে পথ বদলাতে বলা হলো। ম্যানেজার আপত্তি জানালেন। তারা তাদের যুক্তি দিল। কিন্তু কে বুঝবে তাদের ভাষা। আকারে ইঙ্গিতে চেষ্টা হলো, ফল হলো না। সোজা পথ ছেড়ে আমাকে একটু ঘোরা পথে যেতে হলো। ইজিপসিয়ান সাঁতারু কামরুদ্দীন সোজা পথে গিয়ে প্রথম হলো। ঘোরা পথে গিয়ে যখন লক্ষ্যে পৌঁছলাম, তার চার মিনিট আগেই কামরুদ্দীন পৌঁছে গেছে। আমি দ্বিতীয় হলাম।

    চ্যানেল অতিক্রমের প্রস্তুতি চলতে লাগল।

    আরও পড়ুন

    ভিসা ছাড়াই এবার বিশ্বের যে ৪২ দেশে যেতে পারবেন বাংলাদেশিরা

    ব্রজেন দাস
    ব্রজেন দাস
    ছবি: সংগৃহীত

    আমার নম্বর ১৯

    ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট (চ্যানেলের ইংল্যান্ড অংশ) ডোভার থেকে বাস, তারপর প্লেনে করে চ্যানেল ক্রস করে ওপারে (ফরাসি অংশ কালে-তে) নিয়ে যাওয়া হলো। বিশ্রাম শেষে রাত ১২টার সময় আমাদের ডেকে তোলা হলো। বাইরে কাতারে কাতারে গাড়ি আর মানুষ। ছেলে-বুড়ো সব মিলে বেশ বড় একটা মেলা বসে গেছে। তার মধ্যে প্রতিযোগীদের কর্ডন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আমরা ড্রেস করছি, কেউবা (গা) গরম করে নিচ্ছে। ওরই ফাঁকে খবরের কাগজের লোক, রেডিওর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন দেশের সাঁতারুদের কাছে যায়, আমার দিকে আর কেউ আসে না। শেষ পর্যন্ত এক বৃদ্ধ সাংবাদিক আমার দিকে ধীরে সুস্থে এগিয়ে এল, ‘তুমি কিছু বলবে?’

    রাগ চেপে বললাম, ‘না, আমার বলার কিছু নেই। আমি শুধু দেশবাসীর শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ চাই।’

    ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে ফিরে গেল।

    হুইসেল বাজাল। অস্বাভাবিক উত্তেজনা অনুভব করছি।

    গর্জে উঠল পিস্তল। শুরু হলো সাঁতার। ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট সাঁতার কাটার পর কে কোথায় গেল, বোঝার উপায় নেই। প্রতি সাঁতারুর সামনে লঞ্চে ওয়ারলেস অপারেটর আছে। কন্ট্রোল রুমে আছে একটা বিরাট বোর্ড। সেই বোর্ডে সাঁতারুদের নাম আছে। সঙ্গে নম্বর। আধঘণ্টা পরপর কত নম্বরের সাঁতারু কী অবস্থায় আছে, বোর্ডে দেখানো হচ্ছে। শুরুর আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত ১৯ নম্বর, অর্থাৎ আমি সবার চেয়ে এগিয়ে রইলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা আমাকে হারিয়ে ফেলল। আমি বোর্ডে ‘লস্ট’ হয়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর দেখি সব অন্ধকার। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার মাঝামাঝি সময়। রাতও বুঝি শেষ হয়ে আসছে, কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। থিকথিকে কুয়াশা। কোথায় লঞ্চ, কোথায় বোট। আবছা অন্ধকারে স্টিমারের আলো দেখে অনুসরণ করে চলেছি। স্টিমারের খুব কাছেও যাওয়া যায় না। চিৎকার করে ডাকলাম, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। বুঝতে পারলাম অন্ধকার কুয়াশা ও প্রচণ্ড স্রোতে ছন্নছাড়া হয়ে গেছি। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা লঞ্চ যেন চোখে পড়ল। তখনো কুয়াশা, দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছি। একসময় কুয়াশা কেটে গেল। চিৎকার করে উঠলাম। দেখতে পেলাম কূল।

    প্রচণ্ড একটা ঢেউ আমাকে তীরে পৌঁছে দিল। মিসরের সাঁতারু আবদুর রহিমের ১৯৫০ সালের সবচেয়ে কম সময়ের রেকর্ড (১০ ঘণ্টা ৫০ মিনিট) ভেঙে গড়লাম নতুন রেকর্ড (১০ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট)।

    দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে ব্রজেন দাস
    দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে ব্রজেন দাস
    ছবি: সংগৃহীত

    ‘যাও, রানি তোমায় ডাকছেন’

    ১৯৬১ সালে রয়েল লাইফ সেভিং সোসাইটির সদস্য হলাম। অধিবেশনে যোগ দিতে লন্ডন গেছি। রানি এলিজাবেথ উদ্বোধন করবেন। ওখানে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন রানির সঙ্গে। এক ফাঁকে নিরিবিলি গিয়ে সোফায় বসলাম। দেখি পাশেই প্রিন্স ফিলিপস। পায়ে চোট, ব্যান্ডেজ বাঁধা। শুনেছিলাম ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে এই অবস্থা। ভদ্রলোক দু-চার কথা বললেন। এমন সময়ে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে হলরুমে ঢুকলেন। ফিলিপস হেসে বললেন, ‘যাও, রানি তোমায় ডাকছেন।’

    রানি ডাকছেন? গুটি গুটি গিয়ে দাঁড়ালাম রানির সামনে, পাশেই মাউন্টব্যাটেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি চারবার চ্যানেল সাঁতরে পার হয়েছ?’

    ‘হ্যাঁ, চারবার। আবারও চেষ্টা করব।’

    ‘আবারও? কিন্তু কেন?’ রানি প্রশ্ন করেন।

    সাঁতার কেটে চ্যানেল পার হওয়া, সে তো অনেকেই করেছে, আমি চাইছি রেকর্ড করতে, উত্তরটা দিয়ে নিজেই নিজের তারিফ করলাম। মনে মনে বললাম, হু হু এরই নাম বাঙাল।

    তিনি নানা কথা জানতে চাইলেন ও আমার সাফল্য কামনা করলেন।

    রেকর্ড করার পর টেলিগ্রামে আবার তাঁর অভিনন্দন পেলাম।

    1 Comments:

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Alert: Lorem Ipsum is simply dummy text of the printing and typesetting industry.